স্বামী পর্বঃ ০৩...

 স্বামী পর্বঃ ০৩...



নিলয়কে বিদায় দিয়ে নিজের রুমে ঢুকে পিছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে সোহান। আমি পিছনে ফিরে সোহানকে দেখে বললাম,

- আপনার মোবাইলে টাকা আছে..?

- হুম আছে কিন্তু কেন.?

- বাবার কাছে কল দিব। খুব ইচ্ছা করছে কথা বলতে। 

- ঠিকাছে দাঁড়াও আমি কল দিয়ে তোমাকে দিচ্ছি। 

সোহান কল দিয়ে আমাকে মোবাইলটা দিয়ে বলল,

- তুমি কথা বল আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি। 

- আচ্ছা।


কলটা রিসিভ হতে বাবার কথা শুনে হ্যালো বাবা বলতেই বাবা কেঁদে দিয়ে বলল,

- জান্নাত মা কেমন আছিস তুই..? শরীর ভালো তো..? জামাই কোথায়..?


আমি কথা বলতে পারছিলাম না কেমন জানি কষ্টে গলাটা আটকে যাচ্ছে। কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম তোমাদের অনেক মনে পরে বাবা। আমি ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো..? 

- মা রে নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ সবার মন জয় করে চলবি। স্বামী যা বলবে তাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করবি। তুই যাওয়ার পরে তোর মা অসুস্থ হয়ে পরেছে। সারাদিনে কিছু মুখে দেয়নি। আজকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।

- বাবা মায়ের কাছে দাও কথা বলব।

- সারারাত ঘুমাতে পারেনি একটু আগে ঘুমিয়ে পড়েছে। 

- ঠিকাছে বাবা, ডাক্তার কী বলে আমাকে জানিও। এটা তোমার জামাইয়ের নাম্বার। 

- হুম।


বাবার সাথে কথা বলে ভীষণ খারাপ লাগছে আমার। মায়ের সাথে কথা বলার জন্য মনটা ছটফট করছে। খুব দেখতে ইচ্ছা করছে কিন্তু এটা তো কোনভাবেই সম্ভব না। 


সোহানের ছোট বোন সাথী এসে নাস্তা খেতে ডাক দিল। ভাবী সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। 

- হুম চলো।


আমি মাথায় ঘোমটা দিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকলাম। সোহান আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আমি দেখেও না দেখার ভান করে চেয়ারে বসলাম। সোহানের মা একে একে সবাইকে নাস্তা বেরে দিয়ে তিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। টেবিলে ভর্তি লোকজন। খুব লজ্জা লাগছে এতগুলো লোকের সামনে বসে খেতে। কিন্তু কিছু করার নেই। 


সোহান নাস্তা খেয়ে উঠে গেল। একে একে সবাই চলে যায়। আমি সবার শেষে রয়ে গেলাম। আমার খাবার দেখে সোহানের মা রাহিমা বেগম বলল,

- কী রে মা তুই তো কিছু খাচ্ছিস না..? তোর কী লজ্জা লাগছে..?

- নাহ্ মা ঠিকাছি। 


সাথী এসে কাঁধের উপরে হাত রেখে বলল,

- মা তুমি ঠিকি বলেছ ভাবী মনে হয় ভীষণ লজ্জাবতী! আসলে ভাবী তুমি আমার চেয়ে বয়সে ছোট তবুও তোমাকে ভাবী বলতে আমার খুব ভালো লাগছে। জানো ভাবী তোমাকে প্রথম দেখেই বাবার খুব পছন্দ হয়। পরে যখন তোমার বয়সটা জানতে পারে তখন কিছুটা পিছ পা হয়ে যায়। তবুও বাবার কেমন জানি তোমাকে তার পুত্রবধূ হিসাবে মনে ধরেছে। তোমার এই কম বয়সের কথা ভাইয়াকে বলতেই তো সে পুরো ক্ষেপে যায়। বাবাকে বলে আমি কোন বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করতে পারব না। যখন বাবা একটা ধমক দেয় তখনি ভাইয়া রাজি হয়ে যায়। 


সাথীর কথা শুনে আমার খুব হাসি পায় আবার কান্নাও আসে। যে মানুষটা এত কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে করতে চায়নি অথচ সে প্রথম দিনেই যেভাবে আচরণ করেছে তাতে আমি মারা যেতেও পারতাম। 


- সাথী তুমি কী সবার ছোট..?

- হ্যাঁ ভাবী। আমি সবার আহ্লাদী। আমরা চার ভাই বোন। ছোট ভাইয়া বিয়ে করে ভাবীকে নিয়ে আমেরিকাতে থাকে। বছরে একবার করে দেশে এসে বেশীটা সময় শ্বশুড়বাড়িতে কাটিয়ে দেয়। তাই তাদেরকে আমরা কেউ পছন্দ করি না। এক কথায় বলতে পারো আমার ভাই হলো বউয়ের আঁচলের তলে লুকিয়ে থাকা সয়তান। 


রাহিমা বেগম সাথীকে একটা ধমক দিয়ে বলল,

- এটা কী ধরণের কথা..? বড়দের সম্পর্কে কীভাবে মন্তব্য করতে হয় জানিস না..? আমাদের শিক্ষায় কী ভুল ছিল যার কারণে তুই এভাবে কথা বলছিস..? 

- সত্যি কথায় আমি আমার বাপকেও ছাড়ি না আর সে তো আমার ভাই। 

- এই মেয়েটা আমাদের মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিবে কথাটা বলেই তিনি চলে যান। 

- সাথী তুমি খুব প্রতিবাদী মেয়ে তোমার কথাগুলো ভালো লাগছে।

- ভাবী তুমি এত সুন্দর করে কথা বলো কীভাবে..? আমার না হিংসে হচ্ছে..?

- আচ্ছা হিংসে করে লাভ নেই তোমার কথা বলার ধরণও খুব সুন্দর।

- ভালোবাসা ভাবী। ওহ্ হ্যাঁ ভাবী, যা বলতে ছিলাম বড় বোন সিলেটে থাকে। খুব আফসোস করেছে বিয়েতে আসতে না পেরে কারণ দুলাভাই ছুটি পায়নি। তার বাবা মারা যাওয়ার সময় তার পাওনা ছুটি কাটিয়ে ফেলেছে। জুলাইয়ের আগে কোন ছুটি নিতে পারবে না। কিন্তু তুমি চিন্তা করো না আমি আপুর সাথে তোমাকে ভিডিও কলে পরিচয় করিয়ে দিব। জানো আমার আপুটা খুব মিশুক। তোমাকে পেলে সে খুব খুশি হবে। ছোট ভাবীকে সে কত ভালো জানতো নিজের বোনের মতো জানতো। আমাকে একটা কিছু কিনে দিলে তাকেও দিত যদি আমি কিছু বলতাম তখন আমাকে বুঝাত তুই ও তো একদিন পরের ঘরে যাবি তাই রিতুর জায়গায় তোকে কল্পনা করে তারপর রিস করতে আসিস।

আমি তখন উপলদ্ধি করতে পারলাম ভাবী। ভাবলাম আসলেই তো একটা মেয়ে তার পুরো পরিবারকে ছেড়ে অচেনা একটা পরিবারে আসে সেখানে যদি তাকে ভালোবাসা না দেওয়া হয় তাহলে তার দুঃখ রাখার মতো কোন জায়গা থাকে না।


সোহান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সাথীকে ডাক দিয়ে বলল,

- তোদের গল্প শেষ হয়েছে তাহলে জান্নাতকে পাঠিয়ে দিস। 

সোহানের কথাটা আমার কাছে বেমানান লাগছে। বিয়ে হলো মাত্র একদিন তার ভেতরে বোনের কাছ থেকে আমাকে ডেকে নিচ্ছে। 

তার লজ্জা না থাকতে পারে কিন্তু আমার তো আছে। 


রুমে এসে দেখি পায়ের উপরে পা তুলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পা দুটো নাড়াচ্ছে। 


রুমে ঢুকতে ঢুকতে সোহানকে জিজ্ঞাস করলাম কিছু বলবেন.?

- জান্নাত তোমার কী বুদ্ধি শুদ্ধি লোপা পেয়েছে নাকি..? তুমি ডাইনিং টেবিলে এভাবে এত বড় ঘোমটা টেনে দিয়ে গেছো কেন.? শোন, এটা তোমার গ্রামের পরিবেশ না। আমাদের সোসাইটি আর তোমাদের সোসাইটি এক রকম না। তাই আমার সাথে চলাফেরা করতে হলে নিজেকে আমার মতো করে তৈরী করতে হবে। 

তোমাকে এইভাবে সাথে নিয়ে বের হলে আমার সব বন্ধু-বান্ধব আমাকে নিয়ে হাসি তামাশা করবে। কিন্তু আমি এমনটা চাই না। তুমি দেখতে সুন্দরী তাই বলে চলাফেরা গ্রামের মতো গাইয়া ভাবে চলতে পারবে না। কথাটা মাথায় রেখো। 


- দেখুন আমি গ্রামের পরিবেশে বড় হয়েছি তাই শহরের মতো নিজেকে বানাতে অনেকটা সময় লাগবে। এখন আপনি যদি বলেন এই মূহুর্তে আমাকে তারা এনে দাও..? আমি কী এটা আদৌ পারব..? পারব না কারণ তারা এনে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তেমনি আমি নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্ঠা করব কিন্তু সফল হবো কিনা জানি না!

- জান্নাত তোমাকে তৈরী হতেই হবে কারণ আমার সমাজে একটা মূল্য আছে। আমি একটা সরকারী ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। সবাই আমাকে স্যার বলে ডাকে আর সেই স্যারের বউ যদি এখনকার সময়ে বিশাল লম্বা ঘোমটা দিয়ে চলাফেরা করে তাহলে সেটা কেমন লাগবে তোমার দৃষ্টিতে বলো..?

- জানি অনেক খারাপ লাগবে কিন্তু আমাকে বিয়ে করার সময় আপনি তো জানতেন আমি গ্রামের মেয়ে তখন কেন এসব ভাবেননি..?

- কারণ তোমাকে দেখে আমি দুনিয়া ভুলে গেছিলাম যার কারণে মাথায় কিছুই কাজ করেনি কিন্তু এখন আফসোস হচ্ছে যে আমি হয়তোবা ভুল করেছি, বিশাল ভুল। যার মাশুল সারাজীবন আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে। 


স্বামী নামক জন্তুটার কাছ থেকে এমন কথা শোনার পরে আমার পায়ের নিচের জমি ফাঁকা হয়ে গেছিল। আমার তো সব কূল শেষ হয়ে গেছে। আমার জীবনটা আমার পরিবার নষ্ট করে দিয়েছে শুধুমাত্র একজন সরকারী চাকরীজীবি ছেলে দেখে।


চলবে.... 

নতুন পেইজ ফলো করুন 👉 Rubel

Comments

Popular posts from this blog

বাড়ির সোফায় বসে টিভিতে খবর শুনছিলেন জাস্টিস চ্যাটার্জী। ঠিক তখনই একটা খবরে তিনি হতবাক হয়ে যান,- '